২১ February বাংলাদেশের মানুষের কাছে একটি গৌরবময় দিন। দিনটি শহীদ দিবস ও
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পরিচিত। এই দিনটি বাঙালি জনগণের ভাষা আন্দোলনের মর্মান্তিক ও গৌরবোজ্জ্বল স্মৃতি বিজড়িত একটি দিন। ১৯৫২ সালের (৮ ফাল্গুন,১৩৫৮ বঙ্গাব্দ) ঠিক এই দিনেই বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলনরত ছাত্ররা পুলিশের গুলিবর্ষণে শহীদ হন। তাই এ দিনটি শহীদ দিবস হিসেবে সারা বিশ্বে সুপরিচিত হয়ে আছে। ২০১০ সালে জাতিসংঘের গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রতিবছর ২১ February বিশ্বব্যাপী
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
বাংলা ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস
 |
জিন্নাহ উর্ধুকে পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা ঘোষণা করছেন |
দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তানের উদ্ভব হয়। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান সরকার ঘোষণা করে,উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। সাংস্কৃতিক, ভৌগোলিক ও ভাষাগত দিক থেকে পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অনেক মৌলিক পার্থক্য ছিল। কার্যত পূর্ব পাকিস্তানের বাংলাভাষী মানুষ আকস্মিক ও অন্যায্য এ সিদ্ধান্তকে মেনে নিতে পারেননি।এ ঘোষণার প্রেক্ষাপটে তাদের মধ্যে গভীর ক্ষোভের জন্ম হয় ও বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। ফলস্বরূপ বাংলাভাষার সমমর্যাদার দাবিতে আন্দোলন দ্রুত দানা বেঁধে ওঠে। আন্দোলন দমনে পুলিশ ঢাকা শহরে সমাবেশ-মিছিল বেআইনী ও নিষিদ্ধ ঘোষণা করে,১৪৪ ধারা জারি হয়।
 |
ভাষা আন্দোলনে মহিলারা পথে নেমেছেন |
ঐদিন (১৯৫২ সালের ২১ February) সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ১৪৪ ধারা অমান্য করে রাজপথে বেরিয়ে এলে পুলিশ তাদের ওপর গুলি চালায়। এতে আবুল বরকত, আবদুল জব্বার, আবদুস সালামসহ কয়েকজন ছাত্রযুবা হতাহত হন। এ মর্মান্তিক ঘটনার প্রতিবাদে ক্ষুব্ধ ঢাকাবাসী,ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেলে সমবেত হন।বহু নির্যাতন সত্ত্বেও,সাধারণ মানুষ প্রতিবাদ জানাতে,২২ February ঠিক পরের দিনই পুণরায় রাজপথে নেমে আসেন।
 |
ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে বিক্ষোপ সমাবেশ |
ভাষাশহীদদের স্মৃতিকে অমর করতে ২৩ February এক রাতের মধ্যেই মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে গড়ে ওঠে একটি স্মৃতিস্তম্ভ, যা সরকার ২৬
February গুঁড়িয়ে দেয়। ২১ February এই ঘটনার মধ্য দিয়ে ভাষা আন্দোলন আরও গতিশীল হয়। ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করলে, ৯ may অণুষ্ঠিত গণপরিষদের অধিবেশনে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

প্রতি বছর এ দিনটি তখন থেকেই জাতীয় ‘
শোক দিবস’ হিসেবে উদ্যাপিত হয়ে আসছে। বর্তমানে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনায় ২১ February রাত ১২টা এক মিনিটে প্রথমে রাষ্ট্রপতি এবং পরে একাধিক্রমে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদের সদস্যবৃন্দ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, শিক্ষকবৃন্দ, ঢাকাস্থ বিভিন্ন দূতাবাসের কর্মকর্তাবৃন্দ, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন এবং সর্বস্তরের জনগণ কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এসে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করেন। "
আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি" গানের করুণ সুর বাজতে থাকে।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি লাভ
 |
UNESCO |
কানাডার ভ্যানকুভার শহরে বসবাসরত দুই বাঙ্গালী রফিকুল ইসলাম এবং আবদুস সালাম প্রাথমিক উদ্যোক্তা হিসেবে জাতিসংঘের মহাসচিব কফি আনানের কাছে ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দে, ২১ February দিনটিকে
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণার আবেদন জানিয়েছিলেন।
 |
স্মৃতি সৌধ |
১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দের ১৭ November অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর (UNESCO) প্যারিস অধিবেশনে ২১ February
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ২০০০ সালের ২১ February থেকে দিবসটি জাতিসঙ্ঘের সদস্যদেশসমূহে যথাযথ মর্যাদায় পালিত হয়ে আসছে। ২০১০ সালের ২১ October বৃহস্পতিবার জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৬৫তম অধিবেশনে এ-সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে পাস হয়েছে যে "এখন থেকে প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালন করবে জাতিসংঘ।"
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের প্রস্তাবটি সাধারণ পরিষদের ৬৫তম অধিবেশনে উত্থাপন করে বাংলাদেশ। প্রস্তাবটি গত may মাসে ১১৩ সদস্যবিশিষ্ট জাতিসংঘের তথ্যবিষয়ক কমিটিতে সর্বসম্মতভাবে পাস হয়।
 |
শহীদ মিনার |
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই ২১ February সরকারি ছুটির দিন হিসেবে ঘোষিত হয়। এদিন শহীদ দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরে দেশের সংবাদপত্রগুলিও বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে। এছাড়া রেডিও, টেলিভিশন এবং সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো বিভিন্ন অণুষ্ঠানের আয়োজন করে।১৯৫২ সালের ২১ February যে চেতনায় উদ্দীপিত হয়ে বাঙালিরা রক্ত দিয়ে মাতৃভাষাকে
 |
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উৎযাপন |
মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছিল, আজ তা দেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছ থেকে স্বীকৃতি লাভ করেছে।
সমাজ ও ব্যক্তিজীবনের সঙ্গে ভাষার এই ওতপ্রোত সম্পর্কের মধ্যেই তৈরি হয় বাঙালির মানবিক এক প্রাণবন্ত সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতি বাঙালি হিন্দু,মুসলমান,খ্রিস্টান বা বৌদ্ধদের নয়, — এই সংস্কৃতি সকল বাঙালির সমন্বিত সংস্কৃতি।
Comments
Post a Comment